রচনা: আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (সহজ ভাষায়)

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
অথবা, একুশে ফেব্রুয়ারি

উপস্থাপনা : ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ বাঙালি জাতীয় জীবনের একটি ঐতিহ্যপূর্ণ দিন। এর সাথে আমাদের গৌরব ও বেদনার ইতিহাস জড়িয়ে আছে। মাতৃভাষা বাংলার যথার্থ মর্যাদা রক্ষার জন্য অনেককে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল বলে এ দিনটি সমগ্র জাতির নিকট বেদনার রক্তে রঞ্জিত। আবার ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের পথে বাংলাদেশি মানুষেরা তাদের স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছে বলে এ দিনটি জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গৌরবের

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি : ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরপরই ব্রিটিশ সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী স্বায়ত্তশাসন তথা স্বাধীনতার প্রস্তাব নিয়ে ভারতে ‘ক্যাবিনেট মিশন’ আসে। পাকিস্তানের জন্ম সম্ভাবনার প্রেক্ষাপটে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন । তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার দাবি উত্থাপন করেন (১১ই শ্রাবণ, ১৩৫৩ বঙ্গাব্দ) এবং এর সমর্থনে প্রথম বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। এভাবেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পর থেকে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বিতর্কের সূচনা হয়।

বাংলা ভাষার প্রতি বৈষম্য : ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন কর্ণধার মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এক জনসভায় উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু জাগ্রত জনতা এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। তারা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে খাজা নাজিমুদ্দিনের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে পুনরায় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে প্রতিষ্ঠা করার পড়া শুরু হয়।

ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত : ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষার ন্যায্য দাৰি প্রতিষ্ঠার যে ক্ষীণ আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল, শাসকচক্রের অতন্ত তৎপরতায় তা ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠ আন্দোলন সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রদের মধ্যে এ আন্দোলনের সূত্রপাত হলেও সমগ্র দেশ এর সমর্থনে রুখে দাঁড়ায়। ভাষা আন্দোলনের ওপর সরকারের যতই দমননীতি চলতে থাকে, ততই অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো এ আন্দোলনের তীব্রতা ভয়াবহ রূপ নিতে থাকে।

একুশে ফেব্রুয়ারি : ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন সামনে রেখে সারা দেশে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। সরকার এ প্রবল আন্দোলন ঠেকানোর জন্য ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সকল প্রকার সভা-সমিতি ও মিছিল নিষিদ্ধ করে। সরকারের অন্যায়- অত্যাচারের প্রতিবাদে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে প্রতিবাদ মিছিল করতে উদ্যত হয়। এ উদ্যোগ প্রতিহত করার জন্য পুলিশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সম্মুখে ছাত্রদের ওপর বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করে। ফলে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেক তাজাপ্রাণ ঝরে যায়। পৃথিবীতে একমাত্র বাঙালি জাতিই ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত বিসর্জন দিয়েছে।

রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ : এ জঘন্য হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িে পড়লে সমগ্র বাংলাদেশ প্রচণ্ডভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পরিণামে আতংকিত সরকার ১৯৫৬ সালে প্রণীত পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাহ্যিক স্বীকৃতি দেয়। এতে কার্যত বাঙালির জয় হয়।

শহিদ দিবস : ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল, তার জন্য প্রতিবছর ভাবগম্ভীর পরিবেশে শহিদ দিবস উদযাপন করা হয়।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা : কানাডা প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠন Mother Language of the World সর্বপ্রথম এ উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং জাতিসংঘের পরামর্শে তারা বাংলাদেশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এ উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ জানায়। পরবর্তীতে ৯ই সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ সনে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব ইউনেস্কো সদর দপ্তরে পাঠানো হয়। শিক্ষামন্ত্রী ২৮শে অক্টোবর ১৯৯৯ সনে প্যারিসে ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদে এ দিবসটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ‘দিবস’ ঘোষণার প্রস্তাব করেন। যার ফলে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৯৯ সনের ১৭ই নভেম্বর ৩১তম সম্মেলনে এ দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করে। তারপর থেকে প্রতিবছর বিশ্বের ১৮৮টি দেশে একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে উদ্‌যাপিত হয়ে আসছে। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের ও গৌরবের বিষয়।

আরো পড়োসময়ের মূল্য
আরো পড়োতোমার জীবনের লক্ষ্য

উপসংহার : ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস‘ তথা ‘অমর একুশ’ আমাদের জাতীয় জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এটি অধিকার আদায়ের দিন। এরই সিঁড়ি বেয়ে ১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি। তাই এ দিনটির মর্যাদা যাতে ক্ষুণ্ণ না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা সকলের কর্তব্য।