রচনা: স্বাধীনতা দিবস (সহজ ভাষায়)

স্বাধীনতা দিবস
অথবা, ২৬শে মার্চ

উপস্থাপনা : স্বাধীনতা একটি জাতিকে তার নিজের মতো করে দেশ ও জাতি গঠনে ভূমিকা রাখার সুযোগ এনে দেয়। স্বাধীনতা আমাদের সামনেও স্বর্ণদুয়ার খুলে দেয়। স্বাধীনতা দিবস জাতীয় জীবনে অর্জিত একটি লাল তারিখ, স্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের ছাব্বিশে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল এদেশের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র স্বাধীনতার সংগ্রাম। ১৯৭১ সালের ষোলোই ডিসেম্বর দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা বিজয় অর্জন করেছিলাম।

আমাদের স্বাধীনতা দিবস : স্বাধীনতা দিবস জাতি হিসেবে আমাদের আত্মমর্যাদার বর্ণিল স্মারক। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কোনো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি কারও অধীনতা স্বীকার করতে পারে না।

কবির ভাষায়-
‘স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়
দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে কে পরিবে পায়।’

১৯৭১ সালের ছাব্বিশে মার্চ আমরা বিশ্বের বুকে আমাদের স্বাধীনসত্তা জানিয়ে দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলাম। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ছাব্বিশে মার্চের দিবসটি বিশ্বের মানুষের কাছে প্রমাণ করে দিয়েছে যে, বাঙালি বীরের জাতি। পুরো জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতার জন্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। রক্তস্নাত দোআঁশ মাটিকে অবলম্বন করে আবির্ভাব ঘটেছিল নতুন করে এ জাতির। যে যেভাবে পারে অংশগ্রহণ করেছে মুক্তিসংগ্রামে। এক অবিস্মরণীয় সম্মিলনের ঐকতানে মিলিত হয়েছিল এ জাতি। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল এ স্বাধীনতা। আমরা ভুলিনি। ভুলিনি সেই বীরগাথা। মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি। ভুলিনি শহিদদের মহান আত্মত্যাগ।

স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি : ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বর্তমান বাংলাদেশ ব্রিটিশ-ভারত থেকে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের -অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তখন এর নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রত্যাশা ছিল সব ধরনের শাসন-শোষণের অবসান ঘটবে। কিন্তু শোষণ ও বঞ্চনার অবসান হয়নি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরুতেই পাকিস্তানি শাসকচক্র তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তাদের দোসরদের মাধ্যমে অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়েছিল। শোষণ-নিপীড়ন- নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল এদেশের মানুষ। তখন এদেশবাসীর সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি শাসকচক্রের মুখোশ। তারই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে।

স্বাধীনতা ও ভাষা আন্দোলন : ভাষাগত সাংস্কৃতিক-ভৌগোলিক অবস্থান সবকিছুই ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার বিপক্ষে। পাকিস্তান সৃষ্টির শুরুতেই আঘাত আসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির বাংলা ভাষার ওপর। পাকিস্তান শাসকচক্র উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করলে প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এদেশের ছাত্র ও তরুণসমাজ।

রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে এদেশের মানুষ পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। শহিদ হয়েছিল রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেকে। ১৯৫২ সালের মহান একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলন ও চেতনার ধারাবাহিকতায় অর্জিত হয়েছে আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে মহান ভাষা আন্দোলনের সর্বোত্তম প্রাপ্তি- বাঙালির, বাংলা ভাষী মানুষের স্বাধীন আবাসভূমি বাংলাদেশ।

স্বাধীনতা দিবস ও বিভিন্ন আন্দোলন : এদেশের মানুষ কোনো কালেই অন্যায়কে মেনে নেয়নি। নীতির প্রশ্নে আপস করেনি কখনো। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই এদেশের মানুষ বুঝতে পারল যে, নামে স্বাধীন হলেও প্রকৃতপক্ষে তারা স্বাধীন নয়। ইংরেজদের শাসন-শোষণের অবসানের পর তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানি শাসকচক্র এদেশের মানুষের ওপর জুলুম, নির্যাতন চালাতে থাকে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধের পড় তুলে পর্যায়ক্রমে ১৯৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলন, এগারো দফা আন্দোলন, ‘৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থানে এদেশের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধিকারের প্রশ্নে। স্বৈরাচারী পাকিস্তানি শাসকচক্র এদেশের মানুষকে বারবার চেষ্টা করেও সমন করতে পারেনি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এদেশের মানুষের ভোটে আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল।

কিন্তু গণমানুষের রায় উপেক্ষা করে পাকিস্তান সরকার ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতাকে অপব্যবহার করে এদেশে চালায় সামরিক নির্যাতন। ১লা মার্চ (১৯৭১) ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা দেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ৭ই মার্চ থেকে পঁচিশে মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান স্বাধীনতাকামী বাঙালির উত্তাল তরঙ্গের স্রোত অনুধাবন করেছিলেন। তাই পঁচিশে মার্চ রাতে পশ্চিম পাকিস্তানে পাড়ি জমানোর পূর্বে এদেশের মানুষকে নির্বিচারে হত্যার জন্য সেনাবাহিনীর প্রতি নির্দেশ দিয়ে যান। সে নির্দেশ অনুযায়ী পাকিস্তানি হায়েনারা এদেশের ঘুমন্ত মানুষের ওপর নির্বিচারে হামলা চালায় ও নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাংলাদেশের মানুষও ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে।

স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ মাস : স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাসে এদেশের মানুষ প্রাণ দিয়েছে, অত্যাচারিত হয়েছে, মা-বোনেরা সম্ভ্রম হারিয়েছে। জ্বালিয়ে পুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, গ্রামের পর গ্রাম। হানাদার পাকিস্তানিদের দোসর এদেশের রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তিবাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানিদের সহায়কশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। মুক্তিপাগল এদেশের মানুষ সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য মুক্তিবাহিনী গঠন করে। এদেশের ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, ইপিআর, পুলিশ, সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্য ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন কর্নেল এম.এ.জি ওসমানী। মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করে ভারতীয় মিত্রবাহিনী। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান ঘটে ১৯৭১ সালের ষোলোই ডিসেম্বর।

স্বাধীনতা দিবস উদযাপন : ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ রাতে পাক হানাদার বাহিনী এ দেশের মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গণহত্যা চালায়। একই রাতে ধানমণ্ডিস্থ স্বীয় বাসভবন থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের আগে (ছাব্বিশে মার্চ প্রথম প্রহরে) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৯৭১ সালের ছাব্বিশে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল বলে, ছাব্বিশে মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭২ সালের ছাব্বিশে মার্চ বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপন করা হয়।

তারপর থেকে প্রতিবছর এদিনটি স্মরণীয় দিবস হিসেবে যথাযথ মর্যাদার সাথে পালিত হয়ে আসছে। এদিন দেশের সব স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকে। দিবসটি উদ্যাপনের জন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা। হয়। সব ভবনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয়। ভোরবেলা গণজমায়েত হয় বিভিন্ন প্রাঙ্গণে, ফাতেহা পাঠ করা হয়, শহিদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মুনাজাত করা হয় এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। এভাবে সমগ্র দেশে বিশেষ মর্যাদার সাথে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করা হয়।

আরো পড়ো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
আরো পড়োসময়ের মূল্য

উপসংহার : স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। অনেক রক্ত, ত্যাগতিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ। এর জন্য ৩০ লাখ মানুষকে শহিদ হতে হয়েছে, দুই লাখ মা-বোনকে সম্ভ্রম হারাতে হয়েছে। আমরা এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক। এ স্বাধীনতাকে আমাদের যে-কোনো মূল্যে অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। স্বাধীনতার চেতনাপরিপন্থি কোনো কাজে লিপ্ত না হয়ে স্বনির্ভর, সন্ত্রাসমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করতে হবে সকলকে। সুখী, সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়তে পারলেই স্বাধীনতা যুদ্ধের শহিদদের স্বপ্ন পূরণ হবে।