ক্রিকেট খেলার নিয়ম বা আইন কত প্রকার ও কি কি? (জেনে নিন)

ক্রিকেট খেলার জন্ম কোথায়?? সেটা হয়তো অনেকেরই অজানা। ক্রিকেট খেলার জন্ম হচ্ছে ইংল্যান্ডে। একে ‘রাজার খেলা’ নামেও অভিহিত করা হয়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোশাক, দিনব্যাপী খেলা, দুপুরের খাবার, বিকেলের চা-নাশতা, নিয়ম-কানুনের মধ্যে ভদ্র আচরণ এসব কিছু মিলে একে অভিজাত খেলা হিসেবে গণ্য করা হয়। ক্রিকেট খেলার বিপুল জনপ্রিয়তার প্রেক্ষিতে এর নিয়ম-কানুন প্রণয়ন ও নিয়ন্ত্রণ, প্রচার, ব্যবস্থাপনা, প্রভৃতি বিষয়ের জন্য একটি আন্তর্জাতিক কমিটির প্রয়োজন অনুভূত হয়। টেস্ট খেলুড়ে দেশ যথা- ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত, পাকিস্তান এসব দেশের ক্রিকেট বোর্ডের প্রতিনিধিদের নিয়ে ১৯০৯ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল বা আই.সি.সি (ICC) গঠিত হয়। ক্রিকেটের বিষয়ে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এই কমিটি। এই ৭টি দেশের পর শ্রীলংকা, জিম্বাবুয়ে ও বাংলাদেশ টেস্ট খেলার মর্যাদা লাভ করেছে।

ক্রিকেট খেলার নিয়ম বা আইন

ক্রিকেট খেলার আইন ৪২টি। তবে নিম্নে গুরুত্বপূর্ণ ২৪টি আইনের বর্ণনা দেওয়া হলো।

১. পিচ : পিচের দৈর্ঘ্য ২২ গজ, প্রস্থ ১০ ফুট। পিচের দুই মাথায় তিনটি করে স্টাম্প থাকে স্টাম্পের উচ্চতা ২৮”, তিন স্টাম্পের প্রস্থ ৯”। স্টাম্পের মাথার উপর দুইটি বেল বসানো থাকে। বেলসহ স্টাম্পের উচ্চতা ২৮(১/২)”।

২. ক্রিকেট মাঠ : স্টাম্পের মাঝখান থেকে নিচের উভয় পার্শ্বে কমপক্ষে ৬০ গজ থেকে ৭৫ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি অর্ধবৃত্ত আঁকতে হবে। পরে দুই দাগের মাথা সোজা করে রেখা দ্বারা সংযোগ করে দিলেই বাউন্ডারি লাইন হয়ে যাবে। একে ওভাল সাইজ মাঠ বলে। আবার পিচের মাঝখান থেকে ৬০-৭৫ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে বাউন্ডারি লাইন টানা যায়। একে রাউন্ড সাইজ মাঠ বলে।

৩. খেলোয়াড় : দেশের মাটিতে খেলা হলে ১৪ জন এবং বিদেশের মাটিতে হলে ১৫ জন খেলোয়াড় নিয়ে দল গঠন করা হয়। এদের মধ্যে ১১ জন মাঠে খেলায় অংশগ্রহণ করে। অবশিষ্ট ৩ বা ৪ জন খেলোয়াড় অতিরিক্ত হিসেবে থাকে। অতিরিক্ত খেলোয়াড় শুধু ফিল্ডিং করতে পারে। কিন্তু ব্যাটিং, বোলিং ও উইকেট কিপিং করতে পারবে না।

৪. বল : বল গোলাকার হবে। বলের পরিধি হবে ৮০-৯। খেলার পূর্বে বল আম্পায়ার ও উভয়দলের ক্যাপটেন দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে।

৫. ব্যাট : ব্যাটের দৈর্ঘ্য ৩৮ ইঞ্চির বেশি নয়, প্রস্থ ৪ ইঞ্চির বেশি হবে না।

৬. মাঠে খেলোয়াড়দের অবস্থান : একটি দল মাঠে ফিল্ডিং করার সময় বিভিন্ন অবস্থানে দাঁড়াতে হয়। এটা নির্ভর করে বোলারের বোলিং কৌশলের উপর। প্রতি দলে ১১ জন খেলোয়াড় থাকে। তাই ফিল্ডিং করার সময় ১১ জন খেলোয়াড়কে ১১টি স্থানে দাঁড়াতে হয়। তবে মাঠে এর চেয়ে অনেক বেশি অবস্থান রয়েছে। এই অবস্থানগুলি নিম্নরূপ-
থার্ড ম্যান, ডিপ ফাইন লেগ, লং লেগ, ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট, সেকেন্ড স্লিপ, থার্ড স্লিপ, ফার্স্ট স্লিপ, লেগ স্লিপ, স্কয়ার লেগ, গালি, কভার পয়েন্ট, শর্ট একস্ট্রা কভার, সিলি মিড অফ, সিলি মিড অন, শর্ট লেগ, একটা কভার, মিড অফ, মিড অন, মিড উইকেট, লং অফ, লং অন।

৭. ওভার : ৬টি শুদ্ধ বলে এক ওভার হয়।

৮. বাউন্ডারি : ব্যাটে বল লেগে মাটি স্পর্শ করে যখন বাউন্ডারি রেখা অতিক্রম করে তখন তাকে বাউন্ডারি বলে। বাউন্ডারি হলে ব্যাটসম্যানের নামে ৪ রান যোগ হয়।

৯. ওভার বাউন্ডারি : ব্যাটের আঘাতে বল যখন শূন্যে দিয়ে বাউন্ডারি রেখা অতিক্রম করে তখন তাকে ওভার বাউন্ডারি বলে। ওভার বাউন্ডারি হলে ব্যাটসম্যানের নামে ৬ রান যোগ হয়। বল বাউন্ডারি রেখার উপরে পড়লেও ওভার বাউন্ডারি হিসেবে গণ্য হবে।

১০. বাই এবং লেগ বাই: বল যদি ব্যাটসম্যানের ব্যাটের বা দেহের কোথাও স্পর্শ না করে অতিক্রম করে এবং কোনো রান সংগৃহীত হয় তবে আম্পায়ার বাই এবং বল যদি ব্যাটম্যানের ব্যাট বাদে দেহের বা পোশাকের কোনো অংশ স্পর্শ করে অতিক্রম করে ও কোনো রান সংগৃহীত হয় তবে লেগ বাই এর সংকেত দিবেন।

১১. নো-বল : বোলার নিয়ম মাফিক বল না করলে নো-বল হয়। নিম্নের কারণগুলোর জন্য নো-বল ডাকা হয়-
ক. বোলারের কনুই ভেঙ্গে গেলে।
খ. ডেলিভারির স্ট্রাইড (পদক্ষেপ) পপিং ক্রিজ অতিক্রম করলে।
গ. বোলার বল করার সময় উইকেটের কোনো ক্ষতি করলে।
ঘ. বল পিচের অর্ধেকের এপাশে পড়লে।
ঙ. বল সরাসরি ব্যাটসম্যানের কাঁধের উপর দিয়ে চলে গেলে।
চ. নিয়মমাফিক ফিল্ডার অবস্থান না করলে।

১২. ওয়াইড বল : বল ব্যাটসম্যানের খেলার নাগালের বাইরে দিয়ে গেলে ওয়াইড বল হয়। তবে টেস্ট খেলা ও একদিনের খেলার ওয়াইড বলের মধ্যে দূরত্বের পাথক আছে।

আরো পড়ুন >> হকি খেলার নিয়ম কানুন

একজন ব্যাটসম্যান যেসব কারণে আউট হয় :

১৩. রান আউট : রান নেওয়ার সময় ব্যাটসম্যান যদি ক্রিজে পৌঁছার আগেই ফিল্ডারগণ বল দ্বারা বেল ফেলে দেয় তখন ব্যাটসম্যান রান আওতায় পড়বে।

১৪. এল.বি.ডব্লিউ : আম্পায়ার যদি মনে করেন যে লেগস্টাম্পের বাইরে বল ছাড়া কোনো বল ব্যাটসম্যানের পায়ে বা শরীরে প্রতিহত না হলে সরাসরি স্টাম্পে আঘাত করতো তবে তিনি ব্যাটসম্যানকে LBW হিসেবে আউট করে দিবেন।

১৫. বোল্ড আউট : বোলারের বল সরাসরি বা ব্যাটের আঘাতে স্টাম্পে লেগে বেল পড়ে যায় তাহলে ব্যাটসম্যান জাউট হবে। একে বোল্ড আউট বলে।

১৬. কট আউট : ব্যাটসম্যান বল মারার পর বল শূন্যে থাকা অবস্থায় ফিল্ডারগণ বল ধরে ফেললে তখন ঐ ব্যাটসম্যান আউট হবে। এই আউটকে কট আউট বলে।

১৭. স্টাম্পড আউট : নো বল ছাড়া ব্যাটসম্যান বল খেলার জন্য ক্রিজ ছেড়ে বাইরে গেলে ঐ সময় যদি উইকেট কিপার বল ধরে বেল ফেলে দেয় অথবা উইকেট ভেঙ্গে দেয় তাহলে ব্যাটসম্যান স্টাম্পড আউট হবে।

১৮. টাইমড আউট : একজন ব্যাটসম্যানকে আউট হওয়ার পর নতুন ব্যাটসম্যান গার্ড নিতে ৩ মিনিটের বেশি সময় নেয় তখন ঐ ব্যাটসম্যান টাইমড আউটের আওতায় পড়বে। টি টোয়েন্টি খেলার এই সময় ১ মিনিট।

১৯. হিট উইকেট : ব্যাটসম্যান বল খেলার সময় যদি শরীর, ব্যাট বা পোশাকে লেগে বেল পড়ে যায় অথবা উইকেট ভেঙ্গে যায় তখন ব্যাটসম্যান হিট উইকেট আউট হবে।

২০. হিট দ্য বল টোয়াইস : ব্যাটসম্যানের ব্যাটে বা শরীরে বল একবার লাগার পর ব্যাটসম্যান নিজের উইকেট রক্ষার জন্য দ্বিতীয়বার বলে আঘাত করলে বা খেললে আবেদনের প্রেক্ষিতে এই আউটের আওতায় পড়বে।

২১. ইচ্ছাকৃতভাবে হাত দিয়ে বল ধরা : ব্যাটসম্যান ইচ্ছাকৃতভাবে হাত দ্বারা বল ধরলে বা খেললে বা বাধা প্রদান করলে ঐ ব্যাটসম্যান আউট হবে।

২২. ফিল্ডারদের বল ধরতে বাধা প্রদান : ব্যাটসম্যান ইচ্ছাকৃতভাবে ফিল্ডারদের বল ধরতে বাধা প্রদান করলে ঐ ব্যাটসম্যান আউট হবে।

২৩. শতক ও অর্ধশতক: একজন ব্যাটসম্যান বল খেলে ১০০ রান করলে শতক বা সেঞ্চুরি এবং ৫০ রান করলে অর্ধশতক বা হাফ সেঞ্চুরি হয়।

২৪. মেডেন ওভার : একজন বোলার এক ওভারে কোনো রান না দিলে তাকে মেডেন ওভার বলে। সে ওভারে কোনো উইকেট পেলে তাকে মেডেন উইকেট বলে।

কলাকৌশল :
ক্রিকেট খেলায় কলাকৌশলকে প্রধানত চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা-
ক. ব্যাটিং, খ. বোলিং, গ. ফিল্ডিং ও ক্যাচিং, ঘ. উইকেট কিপিং

ক. ব্যাটিং : ব্যাটিং-এর প্রাথমিক কলাকৌশলের মধ্যে রয়েছে- গ্রিপ, স্ট্যান্স, ব্যাকলিফট, স্ট্রোক, গ্ল্যান্স, ড্রাইভ ও হুক। এই সমস্ত কলাকৌশল একজন ব্যাটসম্যান সঠিকভাবে প্রয়োগ করে দর্শকদের সহজে আনন্দ দিতে পারে। ব্যাটসম্যান এই কৌশলগুলো প্রদর্শন করে দ্রুত রান নিয়ে কিংবা দর্শনীয় মারের সাহায্যে বাউন্ডারি মেরে দর্শকদের আনন্দে উত্তেজনায় মাতিয়ে তুলতে সক্ষম হয়।

১. গ্রিপ : ব্যাটিং-এ গ্রিপ গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক গ্রিপ উইকেটের উভয় দিকে স্ট্রোক খেলতে সাহায্য করে। একজন ডানহাতি ব্যাটসম্যান ব্যাটের হাতলের উপরিভাগ বাম হাতে এবং নিচের অংশ ডান হাতে ধরবে। হাত দুটি পাশাপাশি থেকে উভয় হাতের আঙ্গুল ও বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে হাতলটিতে ভালোভাবে আটকিয়ে ধরবে। এতে উভয় হাতের তর্জনী ও বুড়ো আঙ্গুল ইংরেজি ‘V’ অক্ষরের মতো দেখাবে।

২. স্ট্যান্স : একজন ডানহাতি ব্যাটসম্যান পপিং ক্রিজের দুদিকের দু’পা অর্থাৎ ডান পা ক্রিজের মধ্যে এবং বাম পা বাইরে বোলারের দিকে থাকবে। দুপায়ের উপর ভর রেখে সহজ ও স্বচ্ছন্দে দাঁড়াতে হবে। বাম হাত থাকবে বাম উরুর উপর এবং বাম কাঁধ ও চোখের দৃষ্টি বোলারের দিকে থাকবে।

৩. পিছনে ব্যাট উঠানো বা ব্যাক লিফট পিছনে ব্যাট তোলা ব্যাটিং-এর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় দৃষ্টি বলের দিকে এবং বাম কাঁধ ও কনুই বোলারের দিকে থাকবে।

৪. স্ট্রোক বা বল মারা: বলের ধরন অনুযায়ী ব্যাটসম্যানকে বিভিন্ন প্রকার স্ট্রোক খেলতে হয়। এই স্ট্রোক কখনো আক্রমণাত্মক আবার কখনো রক্ষণাত্মক। সামনে এগিয়ে যখন আত্মরক্ষামূলক খেলা হয় তখন তাকে। ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভ স্ট্রোক বলে। এ সময় বাম পা সামনে এগিয়ে যাবে এবং ব্যাট মাটিতে ৩০° থেকে ৪০° কোণ হবে। এ সময় মাটি ও ব্যাটের অবস্থান ইংরেজি ‘V’ অক্ষরের মতো দেখাবে। আবার পিছনে অর্থাৎ উইকেটের দিকে সরে গিয়েও রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে খেলা যায়। একে ফরওয়ার্ড ডিফেন্সিভ স্ট্রোক বলে।

৫. ড্রাইভ : সজোরে আক্রমণাত্মক খেলা খুবই দর্শনীয় হয়। পপিং ক্রিজের বাইরে বাম পা এগিয়ে নিয়ে ব্যাট ডানে উপরে উঠিয়ে সজোরে বলে আঘাত করে বল দূরে পাঠিয়ে দেওয়াকে ফরোয়ার্ড ড্রাইভ বলে।

৬. হুক শট : বোলার যখন শর্টপিচ বল করে তখন বল ব্যাটসম্যান থেকে বেশ কিছুটা দূরে পড়ে লাফিয়ে উঠে। এই লাফিয়ে উঠা বলকে একজন ডানহাতি ব্যাটসম্যান তার ডানপায়ের উপর ভর করে ব্যাট শূন্যে ঘুরিয়ে আঘাত করে এবং বল তার অনসাইডে যায়। হুকশটের জন্য ব্যাটসম্যানের দৃষ্টি, পা ও হাতের কব্জি খুব দ্রুত চালাতে হয়। তবে হুকশট খুবই বিপজ্জনক। দক্ষতা না থাকলে এই শট না নেওয়াই ভালো।

৭. কাট শট : বোলার যদি শট বল করে তাহলে সামনের পা বাড়িয়ে দিয়ে অথবা পিছনের পা ভিতরে দিয়ে বল কাট করা যায়। যারা খেলা শিখছে তাদের জন্য এই কৌশলটি প্রথমে আয়ত্ত করতে যাওয়া ঠিক নয়। এই শটে বল নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অফ স্টাম্পের ২ ফুট বাইরে দিয়ে যাওয়া বলের লাইন ঠিক করে ব্যাট চালাতে হয়।

৮. লেগ গ্ল্যান্স : এই স্ট্রোকে হাতের কব্জি ও হাতকে খুব জোরের সাথে ব্যবহার করতে হয়। ব্যাট করা বল সাধারণত স্কয়ার লেগ ও ফাইনলেগ অঞ্চল দিয়ে বেরিয়ে যায়। লেগ গ্ল্যান্স দু’ভাবে হয়- প্রথম সামনের বাড়িয়ে দেওয়া পা থেকে, আর দ্বিতীয় পা উইকেটের দিকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে গ্ল্যান্স করতে হয়। ব্যাটসম্যানের বাম পায়ের সামনে বা একটু বাইরে বল পড়লে ডান পা মিডল স্টাম্পের দিকে একটু ঘুরে বলে গ্ল্যান্স করতে হয়।

খ. বোলিং : বোলিং ক্রিকেটের অন্যতম প্রধান কৌশল। উঁচুমানের বোলিং-এ ব্যাটসম্যান ব্যাটিংয়ে তেমন সুবিধা করতে পারে না। অনেক সময় আক্রমণাত্মক বোলিং-এ ব্যাটসম্যান দ্রুত আউট হয়ে যায় এবং এর ফলে প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করা সহজ হয়। বোলিং-এর প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু কলাকৌশল নিচে বর্ণনা করা হলো

১. বলের উপর সঠিক গ্রিপ : কোন ধরনের বল করা হবে তার উপর নির্ভর করে বলের গ্রিপে তারতম্য হয়। ফার্স্ট বল ও স্পিন বলের গ্রিপ এক রকম হয় না। তবে যে কোনো ধরনের বল হোক না কেন বলের গ্রিপ নিতে হবে আঙ্গুলের সাহায্যে, হাতের তালু দিয়ে নয়। এতে বল বোলারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

২. রান আপ : বোলার দৌড়ে এসে বোলিং ক্রিজ থেকে ব্যাটসম্যানের উদ্দেশ্যে বল করে। এই দৌড়ে আসার প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দৌড়ানোর ফলে হাত থেকে ছেড়ে দেওয়ার বলের গতি বৃদ্ধি পায়। গতি সম্পন্ন বলে অনেক ব্যাটসম্যান স্বচ্ছন্দে খেলতে পারে না। রান আপে পায়ের পাতা ব্যবহার করতে হয় এবং নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে বারবার দৌড়ে এসে পায়ের পদক্ষেপ ঠিক করে নিতে হয়। এ সময় শরীরের ভারসাম্য একটু সামনে ঝুঁকানো থাকে।

৩. ডেলিভারি : রান আপের শেষ পর্যায়ে এসে হাত থেকে বল ছেড়ে দেওয়াকে ডেলিভারি বলে। একজন ডানহাতি বোলারকে বলের ডেলিভারির পূর্ব মুহূর্তে বাম পায়ের উপর লাফ দিয়ে শরীরকে পাশের দিকে ঘুরিয়ে নিতে হবে এবং এর সাথে ডান পা সামনে, ডান হাত মুখের কাছাকাছি, বাম হাত সোজা উপরের দিকে ও চোখের দৃষ্টি ব্যাটসম্যানের উপর থাকতে হবে।

৪. ফলো-প্রু : বল হাত থেকে ছেড়ে দেওয়ার পর শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য ফলো-থ্রু করতে হয়। বল ছাড়ার পর পরই শরীর দ্রুত ঘুরে যায়, ডান কাঁধ থাকে ব্যাটসম্যানের দিকে। ডান হাত বাম পায়ের পাশ দিয়ে পিছনের দিকে যেতে থাকে। দৃষ্টি থাকে পিচের উপর যেখানে বল পড়ছে। এ সময় কয়েক পদক্ষেপ সামনে যেতে হয়।

ফাস্ট বোলিং
১. ফাস্ট বোলিং ইন স্যুইং : দ্রুতগতির বল বা ফাস্ট বোলিং-এ ইন স্যুইং বল করা সহজ। কিন্তু দূরত্ব ও বলের নিশানা ঠিক রেখে বারবার বল করা মোটেই সহজ নয়। দূরত্ব ও নিশানা ঠিক না থাকলে ঐ বোলারকে অনেক রান দিতে হয়। ইন স্যুইং বলের বৈশিষ্ট্য হলো বল অফ স্টাম্পের সামান্য বাইরে পড়ে দ্রুত উইকেটের দিকে ছুটে যায়। এই বলের গ্রিপে বলের সেলাই তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুলের মাঝে থাকে। বুড়ো আঙ্গুল, কনিষ্ঠা ও অনামিকা আঙ্গুলের গোড়ায় বলটি ধরতে হবে। বলটি এভাবে ধরার উদ্দেশ্য হলো বলের ডেলিভারির সময় বলের সেলাই লেগ স্লিপের দিকে মুখ করে থাকে। ডেলিভারির সময় ডান হাত অনেক উপরে এবং বাম হাত স্বাভাবিকভাবে নিচের দিকে থাকে। ইন স্যুইং বলে শর্ট লেগে দাঁড়ানো ফিল্ডারের কাছে ক্যাচ উঠে।

২. ফাস্ট বোলিং আউট স্যুইং : বলের গ্রিপ ইন স্যুইং বলের মতো তর্জনী ও মধ্যমা দিয়ে বলের সেলাইকে মাঝে রেখে ধরতে হয় এবং বলের নিচে অন্য ৩টি আঙ্গুল থাকে। তবে বলের ডেলিভারির সময় বলের সেলাই প্রথম স্লিপের ফিল্ডারের দিকে মুখ করে থাকে।

স্পিন বোলিং
১. লেগ স্পিন : এখানে স্পিন বোলিং মূলত দু’প্রকারের, সাইড স্পিন ও টপ স্পিন। সাইড স্পিন বোলিং এ বল ঘড়ির কাঁটার মতো কিংবা ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘোরে। একজন ডানহাতি স্পিন বোলার যখন একজন ডানহাতি ব্যাটসম্যানকে স্পিন বোলিং করে এবং বল ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘুরতে ঘুরতে যায় তাহলে সে বল লেগ ব্রেক করে। আবার ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরে ঘুরে গিয়ে পিচে পড়লে সে বল অফ ব্রেক করে। টপ শিম হচ্ছে লেগ ব্রেক ও অফ ব্রেকের সমন্বয়। স্পিন বোলিং-এ বল ডেলিভারির সময় কব্জি বাহুর সমকোণে অবস্থান করে। লেগ স্পিন বোলিং-এ মোটামুটি লেগ স্টাম্পের বরাবরে গিয়ে পিচের উপর পড়ে এবং তারপর গঠি পরিবর্তন করে অফ স্টাম্পের দিকে ছুটে যায়। লেগ স্পিনে বলের গ্রিপ তর্জনী, মধ্যমা ও অনামিকা অর্থাৎ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় আঙ্গুলের মাঝে থাকে, বুড়ো আঙ্গুল বল আটকে থাকতে সাহায্য করে। বল ডেলিভারির সময় বাম কাঁধ খুব উঁচু থাকবে না। কব্জি থাকে ঢিলে অবস্থায় এবং তৃতীয় আঙ্গুল বল স্পিনের কাজ করে।

২. অফস্পিন : অফ স্পিন বোলিং-এ প্রথম ও দ্বিতীয় আঙ্গুল বলের সেলাইয়ের উপর একটু ফাঁক রেখে থাকবে। বুড়ো আঙ্গুল বলের সেলাই বরাবর এবং অপর দ’টি আঙ্গুল নিচে পরস্পর লেগে থাকবে। তর্জনী বা প্রথম আঙ্গুল বলের সেলাইয়ের উপর নিচের দিকে টান দিয়ে বলটি ঘুরাবে। অফস্পিন বল অবশ্যই ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরবে অর্থাৎ বাম থেকে ডানে ঘুরবে। দরজার নব যেমন ঘুরিয়ে দরজা খুলতে গেলে হাতের কব্জি যে কাজ করে, অফ স্পিন বোলিং-এ কব্জি ঠিক সেভাবে ঘুরবে।

৩. গুগলি : লেগস্পিন বোলার একই গ্রিপে যদি অফস্পিন ডেলিভারি দেয় তাকে গুগলি বলে।

গ. ফিল্ডিং ও ক্যাচিং : ক্রিকেট খেলায় ব্যাটিং ও বোলিং-এর ন্যায় ফিল্ডিংও সমান চিত্তাকর্ষক এবং খেলার জয় পরাজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফিল্ডিং-এ যখন কোনো ব্যাটসম্যানকে কট আউট করা হয় তখন তার ক্যাচ ধরায় দর্শক আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠে। প্রত্যেক ক্রিকেটারকে ভালো ফিল্ডার হতে হয়। ফিল্ডিং-এ ক্যাপটেন বা বোলারের ইচ্ছেমতো ফিল্ডারদের দাঁড়াতে হয়। ফিল্ডিং থেকে সংগৃহীত বল সব সময় উইকেট কিপারের কাছে ফেরত পাঠাতে হয়। ফিল্ডিং-এ ক্যাচিং একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। ব্যাটসম্যানের উঠিয়ে দেওয়া বল ধরার জন্য ফিল্ডারকে বলের লাইনের নিচে যেতে হবে। দৃষ্টি বলের উপর থাকবে। দু’হাত খুলে আঙ্গুলগুলো পাশাপাশি রাখতে হবে। হাতের আঙ্গুল ও তালু নমনীয় থাকবে। বল হাতে স্পর্শ লাগার সাথে সাথে হাত বুকের কাছে টেনে আনতে হবে এবং আঙ্গুল বন্ধ করে ফেলতে হবে। বল ক্যাচিং ছাড়া মাঠে গড়িয়ে যাওয়া বলও ফিল্ডারকে থামাতে, কুড়িয়ে নিতে ও থ্রো করতে হয়।

থ্রোয়িং : আক্রমণাত্মক ফিল্ডিং-এ দ্রুত ও সঠিকভাবে থ্রো করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে একজন ভালো ব্যাটসম্যানকে রান আউট করা সম্ভব হয়। শুধু তাই নয়, এতে ব্যাটিং সাইডের রান রেট কমে আসে। ভালো থ্রো করতে হলে নমনীয় কব্জি, হাত ও কাঁধ ব্যবহার করতে হয়। থ্রোয়িং কৌশলের মধ্যে বল হাতের মধ্যে আসার পর কেবল থ্রোয়িং করার উদ্যোগ নিতে হয়। একটু আগে বা পরে হলে বল যেমন ধরা যায় না তেমনি থ্রোও করা যায় না। থ্রো করার সময় কব্জি, হাত, কাঁধ, দু’পা-এর সমন্বিত কার্যক্রম দরকার।

ঘ. উইকেট কিপিং : মাঠে খেলোয়াড়দের যত রকমের অবস্থান আছে, তার মধ্যে উইকেট কিপিং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য দল গঠনের সময় সেরা উইকেট কিপারকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, দ্রুত প্রতিক্রিয়া, শক্তিশালী হাত, শারীরিক শক্তি ও সাহসের অধিকারী হতে হয়। এটা সাধারণভাবে বিবেচনা করা হয় যে, একজন উইকেট কিপার জন্মায় কিন্তু তাকে তৈরি করা যায় না। উইকেট কিপারের সাজ-সরঞ্জাম অন্য খেলোয়াড়দের থেকে আলাদা। উইকেট কিপিং এ প্যাড, গ্লাভস, ইনার গ্লাভস, ক্যাপস, গার্ডস, জুতা এই সাজ-সরঞ্জামগুলো প্রয়োজন। ব্যাটসম্যানের মতো উইকেট কিপারকেও স্ট্যান্স নিতে হয়। কারণ তাকে বোলারের কিংবা ব্যাটসম্যানের কাছ থেকে আসা বল ধরার জন্য সদা প্রস্তুত থাকতে হয়। উইকেটের পিছনে পা ফাঁক করে দু’পায়ের উপর সমান ভারসাম্য রেখে দাঁড়াতে বা অর্ধ বসার ভঙ্গিতে থাকতে হয়। দেহকে নিচু করে দৃষ্টিকে উইকেটের উপরের লাইনে রাখতে হবে। বাম পা থাকবে মধ্য উইকেটের লাইনে, হাত দুটো পাশাপাশি একসাথে, আঙ্গুল নিচের দিকে এবং দৃষ্টি বলের প্রতি নিবদ্ধ থাকবে।

Leave a Comment