বিজয় দিবস

রচনা: বিজয় দিবস অথবা, ১৬ই ডিসেম্বর

বিজয় দিবস

ভূমিকা : ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রাকরে বাংলার যে স্বাধীনতা সূর্য্য অন্তমিত হয়েছিল, তা বহু আন্দোলন সংগ্রাম ও ত্যাগতিতিক্ষার বিনিময়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র নামে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পুনরুদিত হয়; কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-নির্যাতন পাকিস্তানের এ অঞ্চলের মানুষকে পুনরায় স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনমুখী করে তোলে। পরিণতিতে ১৯৭১ সালে নয় মাস ব্যাপী এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। যুদ্ধশেষে ষোলোই ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। ফলে এ দিবসটি আমাদের বিজয় দিবস।

বিজয় দিবসের প্রেক্ষাপট : ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে পাকিস্তান রাষ্ট্র। বর্তমান বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান নামে তখন উক্ত রাষ্ট্রের একটি প্রদেশ ছিল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ। তাদের দুঃশাসন ও অর্থনৈতিক শোষণে এ দেশের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও তাদের নিকট শাসনভার না দিয়ে চলতে থাকে ঘড়যন্ত্র। ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ রাতে পাক হানাদার বাহিনী এ দেশের মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গণহত্যা চালায়। একই রাতে ধানমণ্ডিস্থ দ্বীয় বাসভবন থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ চলে। অবশেষে ষোলোই ডিসেম্বর পাক সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজী মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডারের কাছে আত্মসমর্পণ করলে এ দেশের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। এ কারণে ষোলোই ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবস।

বিজয়ের সেই পরিবেশ : ঢাকায় ষোলোই ডিসেম্বর পাকবাহিনী আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেয়। আত্মসমর্পণের দৃশ্য দেখার উদ্দেশে হাজার হাজার নারী-পুরুষ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। জনপদে কোথাও তিলমাত্র ঠাঁই নেই। মৃদু চলার গতিতে আনন্দের আতিশয্যে তারা আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তোলে। তাদের হৃদয়ভরা আবেগ প্রকাশ পাচ্ছিল। আগমনী দৃশ্য’ দেখে কেউই আবেগ চেপে রাখতে পারেনি। আজ যেন সবাই বাংলার মুক্ত বায়ুতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। আজ জাগ্রত জনতার বিজয় দিবস। আজ নব উদ্যমের জোয়ার এসেছে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহর খুশিতে যেন ফেটে পড়ছে। সব ঘরবাড়ি, দালান-কোঠার শীর্ষদেশে শোভা পাচ্ছে রক্তিম সবুজ বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।

পড়ুন → বাংলা নববর্ষ
পড়ুন → বাংলাদেশের ষড়ঋতু

আত্মসমর্পণের দৃশ্য : মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাজির হন। উন্মত্ত জনতার ভিড় ঠেলে কোনো প্রকারে আসা যেন সম্ভব হচ্ছিল না। মুক্তিবাহিনীর বিজয় উল্লাসে বুকের তাজা রক্ত টগবগিয়ে উঠছিল। ম্লান ভারাক্রান্ত হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাস এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করছিল। মানুষের মনে একদিকে স্বাধীনতার আনন্দ, অপরদিকে স্বজন হারানোর বেদনা। সব মিলিয়ে যেন অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতার লাল সূর্যের দিন।

আত্মসমর্পণ : বাংলাদেশ সময় বিকেল ৫টা ১ মিনিটে আত্মসমর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। পাকবাহিনীর অধিনায়ক লে. জে. নিয়াজী, রাও ফরমান আলী ও বিরানব্বই হাজার সৈন্যের নিয়মিত বাহিনী যুদ্ধবন্দি হয়। তাদেরকে বন্দি শিবিরে নিয়ে যাওয়ার হুকুম দেওয়া হয়।

বিজয় দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য : স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাসে প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষ শাহাদাতবরণ করেছে। তাদের এই আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি আমাদের মহান স্বাধীনতা । আমরা সেই শহিদদের কাছে চিরঋণী। আমাদের সব কাজ ও উন্নয়ন চেতনার মূলে রয়েছে শহিদদের আত্মত্যাগ। তাঁরাই আমাদের অহংকার, আমাদের গৌরব। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে সুসংহত রাখার জন্য আমাদেরও আত্মত্যাগের চেতনায়, উজ্জীবিত হতে হবে। স্বাধীনতা অর্জন যেমন কঠিন, তেমনি তা রক্ষা করা আরও কঠিন। সুতরাং আমাদেরকে দেশপ্রেমিক হতে হবে। দেশের সেবা ও উন্নয়নে আমাদেরকে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে হবে।

উপসংহার : অবশেষে এক জাতির উত্থান আর অন্য জাতির ভাগ্য বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করল ষোলোই ডিসেম্বর। ষোলোই ডিসেম্বরের শুভদিনে জাতীয় জীবনে উদয় হয় রক্তিম রবি। বহু শহিদের প্রাণের বিনিময়ে, সহায়-সম্পদ ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে কাঙ্ক্ষিত ষোলোই ডিসেম্বর আজ আমাদের জাতীয় জীবনে অমূল্য মর্যাদার আসনে সমাসীন। আমরা আজ মুক্ত বিহঙ্গের মতোই স্বাধীন। বিশ্বে আমাদের পরিচয়, আমরা বাংলাদেশের নাগরিক।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *