রচনা: বাংলাদেশের কৃষক (সহজ ভাষায়)

বাংলাদেশের কৃষক
অথবা, বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষক

উপস্থাপনা : বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। দেশের শতকরা ৮০ ভাগ লোক প্রত্যক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এ দেশের অধিকাংশ লোকের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উপায় হচ্ছে কৃষি। আমাদের জাতীয় আয়ের শতকরা ৪৮ ভাগ আসে কৃষি থেকে। তাই আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতির একমাত্র সোপান হচ্ছে কৃষি। কারণ কৃষক ও কৃষির উন্নতির ওপর দেশের উন্নতি নির্ভর করে।

কৃষি ও কৃষক : কৃষি ও কৃষক বাংলাদেশের প্রাণ। পলিমাটি সমৃদ্ধ বাংলার মাঠে-ময়দানে যে বিশাল সবুজের সমারোহ দেখা যায় তার প্রায় সবই কৃষিজাত দ্রব্য। আর সারাক্ষণ হাড়ভাঙা খাঁটুনি দিয়ে যেসব মানুষ বিপুল ফসলের সম্ভার উৎপাদন করে তারাই কৃষক নামে পরিচিত। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। বাংলাদেশ মানেই গ্রামবাংলা, পল্লিবাংলা, মাটি ও মানুষের বাংলা। এক কথায় গোটা বাংলাই কৃষিক্ষেত্র। সুতরাং কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই কৃষিজীবী এবং সমাজে তারা খেটে খাওয়া কৃষক হিসেবে পরিচিত।

কৃষি ও কৃষকের গুরুত্ব : বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নতি ও অগ্রগতিতে কৃষি ও কৃষক কেবল গুরুত্বপূর্ণই নয়, অপরিহার্যও। এখানে কৃষি উৎপাদন ভালো হলে জাতীয় অর্থনীতি হয়ে ওঠে সবল ও সমৃদ্ধ। কিন্তু কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হলে দেশে নেমে আসে অভাব ও দুর্যোগ। বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষক কেবল খাদ্য উৎপাদনেই নয়, পুষ্টি সমস্যা সমাধানে, শিল্পায়নে, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এবং সর্বোপরি জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের দেশে উৎপাদিত পণ্যের অধিকাংশই আসে কৃষি থেকে। খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে শুরু করে শিল্পের কাঁচামাল পর্যন্ত সবকিছুর জোগান দেয় কৃষি।

কৃষি তথা কৃষকের অতীত চিত্র : বাংলাদেশের কৃষকরা একসময় গৌরবময় জীবনযাপন করতো। ‘গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরু’ ছিল প্রতিটি কৃষকের বাড়িতে। পুকুরে ছিল মাছ। মোটা ভাত, মোটা কাপড়ের অভাব হয়নি কোনোদিন বাংলার কৃষকের। অবশ্য এর পেছনে কারণ ছিল। তখন দেশের লোকসংখ্যা ছিল কম, জমি ছিল পর্যাপ্ত। কৃষকদের মহাজনের ঋণের বোঝা বইতে হতো না। তখনকার দিনে কৃষকের স্বাস্থ্য ছিল সবল। মনোবল ছিল অটুট। তাদের সমাজ জীবনে বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠান ছিল। মোট কথা, কৃষকের নিজের হাতে গড়া ‘সোনার বাংলা’ ধনৈশ্বর্যে ভরপুর ছিল। বাংলার কৃষক সুখে দিনযাপন করতো।

আরো পড়ো → বাংলা নববর্ষ
আরো পড়ো → বিজয় দিবস

কৃষি তথা কৃষকের বর্তমান অবস্থা : বর্তমানে বাংলাদেশের কৃষকের কথা মনে পড়লে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে এক রোগজীর্ণ, অস্থি- কঙ্কালসার দৈন্যের চরম প্রতিমূর্তি। পরনে বন্ধু নেই, মুখে চরম হতাশা ও নৈরাশ্যের ছাপ, দারিদ্র্য, ব্যাধি, কুসংস্কার, অশিক্ষা তাকে ঘিরে রাজত্ব করছে। এ হতভাগ্য কৃষকের কথা স্মরণ করেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-
“ওই যে দাঁড়ায়ে নত শির
মূক সবে, ম্লান মুখে লেখা শত শতাব্দীর
বেদনার করুণ কাহিনি,
ক্ষন্ধে যত চাপে ভার
বহি চলে মন্দ গতি যতক্ষণ থাকে প্রাণ তার।”
এটাই হচ্ছে এ দেশের অর্থনীতির নিয়া কৃষকের বর্তমান অবস্থা। ফরাসি দার্শনিক ভলটেয়ার কৃষি ও কৃষকের অবস্থা সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন- The ant which feeds the world is thankless calling.

কৃষি ও কৃষকের দুরবস্থার কারণ : বাংলাদেশের কৃষকের এ করুণ অবস্থার পেছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে। আমাদের কৃষিতে এখনো পুরোপুরিভাবে বিজ্ঞানের ছোঁয়া লাগেনি। এ দেশের কৃষকরা এখনো মান্ধাতার আমলের পদ্ধতিতে জমি চাষাবাদ করে থাকে। ফলে উৎপাদন হয় অত্যন্ত কম। ফসল উৎপাদনের পর কৃষিঋণ এবং মহাজনের দেনা পরিশোধ করার জন্য কম দামে কৃষককে সব ফসল বিক্রয় করে দিতে হয়। ফলে কৃষক প্রকৃত মূল্য থেকে বঞ্চিত হয় । বাংলাদেশের কৃষকদের এক বিরাট অংশ ভূমিহীন। তারা অন্যের জমি চাষ করে। তাই উৎপাদিত ফসলের বেশির ভাগই মালিকের নিকট চলে যায়। ফলে কৃষক দরিদ্র থেকে যায়।

দেশে শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টিপাত হয় না। শুষ্ক মৌসুমে সেচের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করার জন্য গভীর নলকূপ বসানোর সামর্থ্যও কৃষকের থাকে না। যার জন্য কৃষকরা এ সময় ফসল পায় না। এ দেশের কৃষকরা সময় মতো সার কীটনাশক পায় না। ফলে উৎপাদন দারুণভাবে ব্যাহত হয়।

এছাড়া বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিবছর হাজার হাজার একর জমির ফসল ভাসিয়ে নিয়ে যায় বা নষ্ট করে দেয়। ফলে কৃষকের দৈন্য আরও বেড়ে যায়।

সর্বোপরি জমির খণ্ড-বিখণ্ডতা, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, কৃষিখাতে ভর্তুকির অভাব, অজ্ঞতা ইত্যাদি কারণে কৃষকের ভাগ্যের উন্নতি ঘটছে না।

কৃষি ও কৃষকের উন্নতির উপায় : কৃষি ও কৃষকের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কৃষকের নিজস্ব জমির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনের সময় কম দামে কৃষকদের সার ও কীটনাশক সরবরাহ করতে হবে। কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য দিতে হবে। প্রয়োজনের সময় কৃষকদের সুদবিহীন কৃষিঋণ দিতে হবে। পচনশীল ফসল সংরক্ষণের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ তথা কলের লাঙল দ্বারা জমি চাষের সুযোগ করে দিতে হবে। কৃষকরা যাতে কম মূল্যে সার, কীটনাশক সেচ যন্ত্র ও অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতি পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। আধুনিক চাষপদ্ধতি সম্বন্ধে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাছাড়া কৃষকদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে, খামার পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে, কৃষিখাতে অধিক হারে ভর্তুকি দিয়ে কৃষকদের অসুবিধাসমূহ অনেকাংশে লাঘব করা যায়।

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে কৃষির গুরুত্ব : বাংলাদেশে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। দেশে যে বছর কৃষি উৎপাদন ভালো হয় সে বছর কোনো অভাব থাকে না। পক্ষান্তরে কৃষি উৎপাদন খারাপ হলে দেশে চরম অভাব বিরাজ করে। তাই কৃষিনির্ভর এ দেশে কৃষিকে বাদ দিয়ে উন্নতির কথা ভাবাই যায় না। কৃষির গুরুত্বের কথা উপলব্ধি করে আমাদের দেশে কৃষিবিপ্লব ঘটাতে হবে। আর তাহলেই আমরা এ দেশের ষোলো কোটি মানুষের মুখে হাসি দেখতে পাব।

উপসংহার : কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষির উন্নতির জন্য প্রথমে কৃষকদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানে সচেষ্ট হতে হবে। কারণ কৃষক ও কৃষির উন্নতির মধ্যেই আমাদের কল্যাণ নিহিত রয়েছে। মাথা ছাড়া যেমন মানবদেহ ভাবা যায় না তেমনি কৃষির উন্নতি ছাড়াও আমাদের অর্থনীতির উন্নতির কথা ভাবা যায় না। তাই বৈজ্ঞানিক চাষ পদ্ধতির মাধ্যমে কৃষির উন্নতি ঘটাতে পারলেই আমাদের অর্থনীতির মরা গাঙ্গে জোয়ার আসবে। তখন সোনার বাংলা ভরে উঠবে ধনে-ধান্যে, পুষ্প-পল্লবে। প্রখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক গীবনস (GIBBONS) কৃষির গুরুত্ব প্রসঙ্গে বলেছেন- Agriculture is the foundation of manufactures since the productions of nature are the materials of art.

Leave a Comment