রচনা: ইসলাম ও মানবাধিকার (সহজ ভাষায়)

ইসলাম ও মানবাধিকার

উপস্থাপনা : বর্তমান বিশ্বে ‘মানবাধিকার’ একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচিত বিষয়। সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় এবং গণতন্ত্রের জয়যাত্রার পর মানবাধিকার আজ আলোচনার মুখ্য বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। বিশ্বধর্ম হিসেবে ইসলামি জীবনব্যবস্থা বিশ্বজনীন এ মানবাধিকারের সাথে পুরোপুরিভাবে সঙ্গতিপূর্ণ। ইসলাম শুধুমাত্র বিধিবিধান, ধর্মতত্ত্ব এবং শাসননীতি সম্পর্কে আলোচনা করেনি; বরং মানবিক সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সম্বন্ধেও শিক্ষা দিয়েছে। নিচে ইসলাম ও মানবাধিকার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা উপস্থাপিত হলো-

১। পাশ্চাত্যে মানবাধিকার : আমরা জানি যে, পাশ্চাত্য সমাজে মানবাধিকারকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে তারা মানবাধিকার বিষয়ে যথেষ্ট সচেতনতা দেখালেও বাস্তবে সেখানে বর্ণ, পেশা এবং নৃতাত্ত্বিক ভিন্নতার কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যেমন- নেলসন ম্যান্ডেলার মতো বিশ্ববরেণ্য নেতাকে জীবনের অধিকাংশ সময়ই কাটাতে হয়েছে কারাগারে। শুধুমাত্র বর্ণের কারণে।

২। ইসলাম ও মানবাধিকার : ইসলামের কয়েকটি মৌলিক নীতি বিশ্বজনীন মানবাধিকারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন-
ক. আইনের শাসন : ইসলামি তত্ত্ব অনুযায়ী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় আইনের ভিত্তিতে। তাই আইন রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের ওপর সমভাবে প্রযোজ্য। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ইসলামি বিধান হলো, নির্মোহ ও নিরপেক্ষ প্রক্রিয়ায় আইনের প্রয়োগ করতে হবে।

খ. একত্ববাদ : ইসলামের মৌল ভিত্তি হলো একত্ববাদ। মিসরের দার্শনিক হাসান হানাফীর মতে, তৌহিদ বা একত্ববাদের আরেকটি অর্থ রয়েছে, তা হলো যে-কোনো নিপীড়ন, নির্যাতন থেকে মুক্তির ঘোষণা।

গ. মানবকল্যাণ : ইসলামে মানবকল্যাণ সাধনের কথা বলা হয়েছে। একজন মুসলমান কখনো অন্য মুসলমানের অকল্যাণ সাধন করতে পারে না। ইসলাম বলেছে, একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের কল্যাণ সাধনের মাধ্যমেই স্রষ্টার নিকটবর্তী হতে পারে।

ঘ. পরিবারের পবিত্রতা : পরিবারই হলো ইসলামি সমাজের প্রধান উপাদান। পরিবারের পবিত্রতা এবং পরিবারের মৌল বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ ইসলামের মহান আদর্শ। পরিবারই ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য বিকশিত করে। ব্যক্তিত্বের সবুজ দলগুলো পরিবারেই পরিণত রূপ লাভ করে। পরিবারেই ধর্মীয় চেতনা বা বিশ্বাসের কুঁড়ি ক্রমে ক্রমে সুদৃশ্য বিকশিত তছরূপ লাভ করে। সুতরাং পরিবারের পবিত্রতা সংরক্ষণকারী ইসলামি নীতি মানবাধিকারের পরিপন্থি নয়।

আরো পড়ো →বৃত্তিমূলক শিক্ষা
আরো পড়ো →ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য

ঙ. ব্যক্তিস্বাধীনতা : ইসলামে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা স্বীকৃত। স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যের মাধ্যমেই ব্যক্তি জীবনের লক্ষ্য স্থির হয়। যেহেতু ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ইসলামে স্বীকৃত, সেহেতু সে পথ ধরেই স্বীকৃত ব্যক্তিগত দায়িত্বের সূত্র এবং এসবই মানবাধিকারের সাথে জড়িত। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ইসলাম, ও মানবাধিকার একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।

চ. শিশুর অধিকার : বিশ্বের সর্বত্রই কমবেশি শিশুর অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বে দারিদ্র্য এবং নিরক্ষতা এর মূল কারণ। পশ্চিমাবিশ্ব মানবাধিকারের বুলি আওড়ালেও প্রকৃতপক্ষে সেখানে তারা একজন শিশুকে চরম অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেখানে সুদৃঢ় পারিবারিক বন্ধন না থাকায় একজন শিশু জন্ম নিয়েই অনেক ক্ষেত্রে পিতৃহীন অবস্থায় পতিত হয়। আবার পশ্চিমা অনুসারী অনেক মাতা নিজের সৌন্দর্য রক্ষার্থে শিশুকে বুকের দুধ হতে বঞ্চিত করে। অথচ ইসলাম একটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ লাভে তার পিতামাতা উভয়ের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করে মানবাধিকার সংরক্ষণ করেছে।

ছ. নারীর অধিকার : নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী-স্বাধীনতার নামে বর্তমান বিশ্বে নারীকে চরম দুর্দশা ও বঞ্চনার শিকারে পরিণত করা হচ্ছে। আর ইসলাম নারীকে ব্যক্তিগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ সকল ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগদানের মাধ্যমে মানবাধিকারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মহান আল্লাহ বলেন, “নারীরা তোমাদের (পুরুষদের) বসনস্বরূপ আর তোমরা (পুরুষরা) নারীর বসনস্বরূপ।” মহানবি (স) বলেছেন, “পুরুষদের প্রতি নারীর সেরূপ অধিকার রয়েছে যেরূপ অধিকার রয়েছে নারীর প্রতি পুরুষের।”

জ. প্রতিবেশীর অধিকার : সাধারণত প্রতিবেশীরা পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব সচেতন না হলে একজনের দ্বারা অন্যজনের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়ে থাকে। এজন্য ইসলাম প্রতিবেশির প্রতি কিছু বাড়তি দায়িত্ব অর্পণ করেছে। মহানবি (স) বলেছেন— সে ব্যক্তি প্রকৃত মুমিন নয় যার মুখ ও হাত হতে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়। এভাবে ইসলাম মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন বিধিবিধান প্রবর্তন করেছে।

৩। সর্বজনীন মানবাধিকার : ইসলাম বর্ণ, ধর্ম, গোত্র নির্বিশেষে সকলের মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার গ্যারান্টি দিয়েছে। অথচ আজ বিশ্বের দিকে দিকে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। বসনিয়া, কাশ্মীর, আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিন ও আলজেরিয়া এর বাস্তব প্রমাণ। মূলত ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠিত না থাকায় বর্তমান বিশ্বে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।

উপসংহার : ইসলাম এক জীবন-ঘনিষ্ঠ বিশ্বধর্ম। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে ইসলাম নির্দেশিত পথে অগ্রসর হয়ে সাফল্য অর্জন সম্ভব। পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক সমাজে মানবাধিকার যেমন বাস্তবায়িত হয়, তেমনি কোনো কোনো সমাজে এর রুচিহীন বিকৃতিও লক্ষণীয়। মুসলিম বিশ্বেও তেমনি রয়েছে মানবাধিকার চর্চার উর্বর ক্ষেত্র, যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, মৌলিক মানবাধিকারের চরম অবমাননা। বিশ্বধর্ম হিসেবে এজন্য ইসলাম দায়ী নয়; বরং ইসলামই মানবাধিকার সংরক্ষণ ও বিকাশের এক উজ্জ্বল দীপশিখা।

Leave a Comment