ডিম কেন খাবেন? জেনে নিন ডিমের উপকারিতা ও নানাবিধ পুষ্টিগুণ

ডিমের উপকারিতা রয়েছে অনেক। তবে অনেকেই ডিমের সঠিক পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জানেন না, রয়েছে অনেক ভ্রান্ত ধারণা। সুস্থ্য-সবল থাকতে বিশেষজ্ঞরা প্রতিদিন একটি করে ডিম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। শিশু থেকে বৃদ্ধ, সব বয়সের জন্যই ডিমের উপকারিতা রয়েছে। তবে এলার্জিজনিত কারণে অনেকে ডিম খেতে চান না।
এবারের আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে ডিমের উপকারিতা ও নানাবিধ পুষ্টিগুণ সম্পর্কে। তাছাড়া জানবো কোন কোন বয়সে ডিমের চাহিদা কেমন সে সম্পর্কে।

ডিম কেন খাবেন?

ডিমে রয়েছে নানাবিধ পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা। কারণ ডিমে এমন কিছু উপাদান রয়েছে যার ফলে অন্যান্য প্রাকৃতিক খাদ্যের তুলনায় অধিকতর কার্যকরী। কারণ স্বাভাবিক সাইজের একটি ডিম থেকে প্রায় ১৪৩ গ্রাম ক্যালরি পাওয়া যায়। তাছাড়া কার্বোহাইড্রেট ০.৭২ গ্রাম, প্রোটিন ১২.৫৬ গ্রাম, ফ্যাট ৯.৫১ গ্রাম, ফসফরাস ১৯৮ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ১৩৮ মিলিগ্রাম ও জিঙ্ক ১.২৯ মিলিগ্রাম পাওয়া যায়। যা অন্যান্য প্রাকৃতিক খাদ্যের তুলনায় বেশি হওয়ায় ডিমের পুষ্টিগুণ অন্যান্যদের তুলনায় বেশি।

ডিমের উপকারিতা

এনার্জি পাওয়া যায় :
সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে শরীরে এনার্জি পাওয়ার জন্য সকালে একটা সিদ্ধ ডিম ই যথেষ্ট। মূলত ডিম থেকে পাওয়া ভিটামিন এই শক্তির জোগান দেই। ডিম থেকে পাওয়া ভিটামিন- বি আমাদের খাওয়া সকল খাদ্যকে এনার্জি বা শক্তিতে রূপান্তর করে৷ যার ফলে সকালে একটি সেদ্ধ ডিম খেলে সারাদিন এনার্জেটিক থাকা যায়।

চোখের সমস্যা সমাধান করে :
ডিম থেকে ভিটামিন- এ পাওয়া যায়। দৃষ্টিশক্তি উন্নতিতে ভিটামিন- এ বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাছাড়া ডিম থেকে কেরোটিনয়েড ও ল্যুটেন পাওয়া যায়। বয়স হয়ে গেলে চোখে ম্যাকুলার ডিজেনারেশন নামক এক বড় ধরনের সমস্যা দেখা যায়, যা কেরোটিনয়েড ও ল্যুটেনের ফলে এই সমস্যা এই সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক অংশেই কমে যায়। চোখের ছানিও কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

ক্যান্সার প্রতিরোধ করে :
মরণব্যাধি রোগের মধ্যে ক্যান্সার অন্যতম। খেয়াল করলে দেখা যায়, বর্তমানে এই রোগ প্রতিটি ঘরে ঘরে আবার এই রোগের চিকিৎসাও ব্যয়বহুল। অনেক সময় প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগের চিকিৎসা না করা হলে মৃত্যুও হতে পারে।
তবে ডিম থেকে পাওয়া ভিটামিন- ই আমাদের কোষ ও ত্বকে অবস্থিত ফ্রি র‍্যাডিকেল কোষ ধ্বংস করে দেয়। যার ফলে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশেই কমে যায়।
তাছাড়া বয়ঃসন্ধিকালীন পিরিয়ডের সময় নিয়মিত একটি করে ডিম খেলে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে।

মেয়েদের সুস্থ্য থাকার জন্য :
একজন মেয়ের শরীর সুস্থ্য থাকার জন্য প্রতিদিন ৫০%-৬০% প্রোটিনের প্রয়োজন হয়, যেটা ডিম থেকেই জোগান দিতে সক্ষম। কেননা, একটি ডিম থেকে ৮০-৯০ গ্রাম পাওয়া ক্যালরি ৬.৫ গ্রাম প্রোটিন তৈরি করতে পারে।
তাই মেয়েদের সুস্থ্য থাকতে প্রতিদিন একটি করে ডিম খাওয়া প্রয়োজন।

পেশির ব্যাথা নিরসনে :
শুধু বয়স হলেই না, অল্প বয়সেও পেশির ব্যাথা হতে পারে। পেশির ব্যাথা নিরসনে ভিটামিন- ডি খুবই উপকারী। আর আমরা ডিম থেকে খুব সহজেই ভিটামিন- ডি পেয়ে থাকি। তাই পেশি মজবুত করতে ডিম খাওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি যারা নিয়মিত ব্যায়াম করে তাদেরও নিয়মিত ডিম খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

হার্ট সুস্থ্য রাখে :
শরীরের প্রধান অংশ হচ্ছে হার্ট। তাই হার্টকে অবশ্যই সুস্থ্য রাখতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, ডিম হার্টে রক্ত জমাট বাধা রোধ করে। তাই নিয়মিত ডিম খেলে হার্ট এট্যাকের সম্ভাবনা কমে যায়। পাশাপাশি সারা দেহে রক্ত সঞ্চালন সচল ও স্বাভাবিক রাখে

কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখে :
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি। সেক্ষেত্রে ডিম ভালো ভূমিকা রাখে। ডিমে থাকা ওমেগা-৩ কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে এবং ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা প্রায় ১০% বৃদ্ধি করে।

অ্যামিনো এসিডের উৎপত্তি :
মানবশরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী হচ্ছে প্রোটিন। কিন্তু আমরা কি জানি এই প্রোটিনের মূল উৎস কি?
প্রোটিনের মূল উৎস হচ্ছে অ্যামিনো এসিড। ২১টি অ্যামিনো এসিডের সমন্বয়ে প্রোটিন তৈরি হয়। যার মধ্যে ১২টি অ্যামিনো এসিড শরীরে উৎপন্ন হলেও বাকি ৯টি অ্যামিনো এসিড বাইরে থেকে সংগ্রহ করতে হয়। আর সেটা জোগান দেই ডিম।

নখ ভালো রাখতে :
নখের একটি সাধারণ সমস্যা হচ্ছে নখ ভেঙ্গে যাওয়া। বিভিন্ন কারণেই নখ ভাঙ্গতে পারে, তার মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে নখের যত্ন না নেওয়া। কিন্তু সালফারের ঘাটতি হলে নখ দুর্বল হয়ে যায় এবং ভাঙ্গতে শুরু করে। অপরদিকে ডিম থেকে সালফার পাওয়া যায়। তাই নখ মজবুত, সুন্দর ও সাদা রাখতে প্রতিদিন ডিম খেতে পারেন।

রক্তস্বল্পতা দূর করে :
রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়ায় ভোগেন এমন অনেকেই আছেন। অধিকাংশ মেয়েদের রক্তস্বল্পতা হওয়ার কারণে অ্যানিমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়। আর আয়রন এই অ্যানিমিয়া হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। এবং ডিম থেকে আয়রন পাওয়া যায়।
তাই, পিরিয়ডের সময় মেয়েদের রক্ত বেরিয়ে যাওয়ার কারণে রক্তস্বল্পতায় ভোগেন, ক্লান্ত হয়ে যায়। তাই পিরিয়ডের সময় নিয়মিত ডিম খেলে সেই ক্লান্তি দূর করে।

রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে :
ঘনঘন সর্দি-কাশি বা জ্বর হলেই বুঝবেন রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে। রোগ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ডিম ভালো ভূমিকা রাখে। কারণ ডিমে থাকা জিঙ্ক শরীরের কমিউনিটি সিস্টেমকে আরো শক্তিশালী করে।

হাড় ও দাঁত মজবুত রাখে :
অনেকের বাতের ব্যাথা হতে দেখা যায়। বাতের ব্যাথা মূলত হাড় শক্তিশালী না হওয়া বা ক্ষয়ে যাওয়ার কারণে হয়ে থাকে। তবে হাড় শক্তিশালী করতে প্রয়োজন ফসফরাস। আবার ফসফরাস দাঁত মজবুত করতেও সহয়তা করে। ডিম থেকে ফসফরাস পাওয়া যায়।
তাই হাড় ও দাঁত মজবুত রাখতে প্রতিদিন ডিম খাওয়া প্রয়োজন।

ওজন নিয়ন্ত্রণ রাখে :
আমরা নিয়ম মেনে না খেয়ে অনেক সময় অতিরিক্ত খাবার খেয়ে থাকি যার ফলে ওজন বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু এই অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি রোধ করবে ডিম। কারণ ডিম শরীরে থাকা ৪০০ ক্যালরি কমাতে সক্ষম তাই ওজনও নিয়ন্ত্রণে থাকে।

ডিমের কুসুম নিয়ে ভুল ধারণা
ডিমের কুসুম নিয়ে সবার একটি প্রচলিত ভুল ধারণা আছে। সেটা হচ্ছে, ডিমের কুসুমে অধিক কলেস্টেরল থাকায় যাদের করোনারি হার্ট ডিজিজ বা রক্তে কলেস্টেরলের মাত্রা বেশি তাদের কুসুম ছাড়া ডিম খেতে দেওয়া। কিন্তু বর্তমানে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত, ডিমের কুসুমে যে কলেস্টেরল আছে তা রক্তের কলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায় না এবং করোনারি হার্ট ডিজিজের সাথে কোনো সম্পৃক্ততা নাই।
প্রতিদিন কুসুমসহ ডিম খাওয়া আমাদের সবার জন্যই উপকারী। একটা সম্পূর্ণ ডিমের অর্ধেক পুষ্টি কুসুম থেকেই পাওয়া যায়। তাছাড়া কুসুমে আমাদের জন্য উপকারী কিছু উপাদান যেমন ফলেট, কোলিন, ভিটামিন- এ, ভিটামিন- ডি, ভিটামিন- ই, লেটিইন এবং জি-অ্যাকজানথাইন ইত্যাদি পাওয়া যায়। তাই, কুসুম বাদ দিয়ে না, বরং কুসুমসহ ডিম প্রতিদিন একটা করে খেলে বেশি উপকারী আমাদের জন্য।

বয়সভেদে ডিম খাওয়ার নিয়মাবলি
শিশু :
চিকিৎসকরা সাধারণত শিশুর বয়স এক বছর হওয়ার পর থেকে ডিম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকে। ডিম থেকে প্রাপ্ত প্রোটিন শিশুর দেহের ক্ষয়পূরণ ও সঠিক বৃদ্ধির জন্য বিশেষ ভুমিকা রাখে। তাছাড়া ডিম কুসুমে থাকা কোলিন শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশে সহায়তা করে। তাছাড়া শিশুদের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান ভিটামিন- এ, ভিটামিন- ডি, ভিটামিন- ই ও আয়রন পাওয়া যায়।
তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এক বছর পর থেকে দৈনিক একটি করে এবং তিন বছর পর থেকে দৈনিক দুইটি করে ডিম খাওয়া যেতে পারে।

কিশোর :
এই বয়সে শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা যায়। তাছাড়া হরমন ও এনজাইমের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়, পড়ালেখার চাপ বাড়ে। যার ফলে পুষ্টি উপাদানের চাহিদা বেড়ে যায়। তাই পুষ্টি উপাদানের চাহিদা পূরণে দৈনিক দুইটা করে ডিম খাওয়া স্বাস্থ্যকর।

প্রাপ্তবয়স্ক :
এই বয়সে কাজের চাপ একটু বেশিই থাকে। যার ফলে সঠিক সময়ে খাওয়া অথবা সঠিক ডায়েট চার্ট ফোলো করা হয়না। যার ফলে অনেক সময় পুষ্টিহীনতায় ভুগে। পুষ্টিহীনতা দূর করতে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতিদিন কুসুমসহ দুইটা ডিম এবং তার সাথে কুসুম ছাড়াই শুধু সাদা অংশ খেতে পারে।

গর্ভবতী মা :
স্বাভাবিক দৃষ্টিতে একজন স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় গর্ভবতী মা এর পুষ্টি চাহিদা বেশি হয়ে থাকে। ভ্রুণের সঠিক গঠন ও বিকাশের জন্য ডিম কার্যকরি ভূমিকা রাখে। তাছাড়া গর্ভাবস্থায় রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে, ভ্রুণের হাড়, মস্তিষ্ক ও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঠিক গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল উপাদানের মধ্যে বেশিরভাগ পুষ্টি উপাদান ডিমে পাওয়া যায়।
তাছাড়া জন্মগত বিভিন্ন ত্রুটি সমাধানেও ডিম ভালো ভূমিকা রাখে।

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে জানা গেলো ডিমের উপকারিতা অনেক। তাই, একজন শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক এমনকি বৃদ্ধা পর্যন্ত সকল বয়সের ব্যক্তির জন্য প্রতিদিন নিয়মিত ডিম খাওয়া অত্যন্ত জরুরি।

Leave a Comment