রচনা: পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা বা, লাইব্রেরি (সহজ ভাষায়)

পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা
অথবা, লাইব্রেরি
অথবা, মানবসভ্যতা ও গ্রন্থাগার

উপস্থাপনা : সব রকমের বই যেখানে সযত্নে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়, তাকে গ্রন্থাগার বলে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় গ্রন্থাগারে শত বছরের মহাসমুদ্রের কল্লোল যেন ঘুমিয়ে থাকে। মানুষ বিবেকবুদ্ধি, আবেগ-অনুভূতি এবং জীবনবোধের ঐশ্বর্যে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। বিচিত্র জীবনের অনুভূতি তার হৃদয়কে নাড়া দেয়, ভাবনাকে জাগ্রত করে। মানুষ এই আবেগের প্রকাশ থেকে বিরত থাকতে পারে না। আত্ম উপলদ্ধির সেই চৈতন্যকে ধরে রাখে শিল্প, সাহিত্য, সংগীত ও চিত্রকলা। বই আকারে প্রকাশিত যুগযুগান্তরে ঐসব চিন্তা ও হৃদয়াবেগ গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত থাকে। এভাবে সকল যুগের মানুষ গ্রন্থাগারে সৃষ্টির সেতু বেয়ে একত্রে মিলিত হয়। তাই গ্রন্থাগারের অপর নাম মনীষীদের মিলনক্ষেত্র।

শ্রেণিবিভাগ ও অতীত ধরন : পাঠাগার তিন রকম হতে পারে- ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ। ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার ব্যক্তির রুচি ও প্রয়োজন অনুসারে গড়ে ওঠে। ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারই ক্রমে পারিবারিক গ্রন্থাগারে পরিণত হয় এবং পরিবারের সকলের রুচি অনুযায়ী কিছু কিছু বই সংযোজিত হয়ে গ্রন্থাগার হয় সমৃদ্ধ। প্রাতিষ্ঠানিক গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এই ধরনের গ্রন্থাগার থাকে। সাধারণ পাঠাগার সাধারণত জনসাধারণের চেষ্টায় গড়ে তোলা হয়। সদস্য হয়ে অথবা নিয়মিত চাঁদা প্রদানের ভিত্তিতে সকলেই এখানে বই পড়ার সুযোগ পায়। পাঠাগার গড়ে তোলার উদ্দেশ্য বই পড়ার মধ্য দিয়ে সুস্থ সময় কাটানো এবং জ্ঞানলাভের পথ প্রশস্ত করা ও মানবিক বিকাশ সাধন করা। সবাই লেখক হবে এমন কোনো কথা নেই। পাঠক হওয়াই বড় কথা এবং সেই কাজটি গ্রন্থাগার অনায়াসে সাধন করতে পারে। গ্রন্থাগারে শুধু দেশের নয় সকল দেশের সকল যুগের উল্লেখযোগ্য বই সংরক্ষিত হয়। ওখান থেকে নিজ নিজ রুচি অনুযায়ী বই সংগ্রহ করে পড়া পাঠকের দায়িত্ব। এমন সময় ছিল মুদ্রণযন্ত্রের অভাবে ছাপানো বই পাওয়া যেত না। রাজা মহারাজাদের গ্রন্থাগারে হজ্বলিখিত বহু পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে। এমনকি কাগজের অভাবে তালপাতা, চামড়া, ভুজপত্রে লিখিত গ্রন্থাদিও পাওয়া গেছে।” বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কারের ফলে আজকের পাঠাগার সমৃদ্ধ। প্রথম শতাব্দীতে গ্রীসের রোম নগরে জনসাধারণের জন্য প্রথম গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়। প্রাচীন যুগে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের নাম উল্লেখযোগ্য। একসময় বাগদাদ, কায়রো, কর্ডোভা ও আলেকজান্দ্রিয়ার বিশাল বিশাল গ্রন্থাগার সারা পৃথিবীতে সাড়া জাগিয়েছিল। আধুনিক গ্রন্থাগারের সঙ্গে অবশ্য এগুলোর অনেক তফাত বিদ্যমান।

আরো পড়ো → ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য
আরো পড়ো → শ্রমের মর্যাদা

বর্তমান পর্যায় : বর্তমানে গ্রন্থাগার রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে উন্নতমানের নিয়মকানুন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতি রীতিমতো বিজ্ঞানভিত্তিক। চোখের পলকে একজন দক্ষ গ্রন্থাগারিক যে কোনো যুগের ইতিহাস অথবা যে কারো লেখা একটি কবিতার বই অতি সহজে বের করে দিতে পারে। পাঠক তার চাহিদা মতো বইটি গ্রন্থাগারে আছে কিনা তাও এক পলকে দেখে নিতে পারে। বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাগারের মধ্যে অন্যতম।

মানবসভ্যতা ও গ্রন্থাগার : মানুষের সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশের সঙ্গে গ্রন্থাগার নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। যে জাতি যত বেশি উন্নত তার পাঠাগার তত উন্নত উপায়ে জনগণের কাছাকাছি চলে এসেছে। কারণ জ্ঞানই শক্তি এবং এই জ্ঞানের উৎস বই। যত বেশি পড়া যায় তত বেশি জানা যায়। তবে সব বই কিনে পড়া সম্ভব নয়। অতএব গ্রন্থাগার গড়ে তোলাই উন্নত জাতির বিশেষ পরিচয়। মানুষ কেবল খেয়ে বাঁচতে পারে না। তার মনের ক্ষুধা মিটানো আবশ্যক। সেই ক্ষুধা মিটে কেবল বই পড়ার মধ্য দিয়ে মনুষ্যত্ব অর্জনের মাধ্যমে। মনুষ্যত্বহীন মানুষ পশুর সমান। তাই গ্রন্থাগার স্থাপনের উদ্যোগ ঘরে ঘরে নেওয়া আবশ্যক। শহর বা গ্রামের যে-কোনো অঞ্চলে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক। ঐসব গ্রন্থাগারে প্রাচীন পাণ্ডুলিপি থেকে আরম্ভ করে দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ এবং। আধুনিক গ্রন্থাবলি সংরক্ষিত হওয়া উচিত।

উপসংহার : এক কথায় গ্রন্থাগারকে বলা যায় আলোর মশাল। সে আলো জ্ঞানের আলো। জীবনের বিচিত্র পথে তা মানুষের বহুবিধ সুখ, দুঃখ, আনন্দ, সমস্যা এবং সমস্যার সমাধানকে বুকে ধারণ করে জ্ঞানতাপসের মতোই নীরবে নিভৃতে মানবমনের মুক্তির সন্ধান দেয়। মানুষ খুঁজে পায় দুঃখে শান্তি, সুখে আনন্দ, সমস্যার সমাধান এবং দুর্জয় জীবনকে জয় করার অদম্য শক্তি ও সাহস। তাই গ্রন্থাগার হোক আমাদের সার্বক্ষণিক অবস্থানস্থল।

Leave a Comment